মুক্তিবাহিনী গঠন ও কার্যক্রম

অষ্টম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ | NCTB BOOK

মুজিবনগর সরকার সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী। এছাড়া চিফ অব স্টাফ ছিলেন কর্নেল (অব.) আবদুর রব। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার।

মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর : মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। প্রত্যেক সেক্টর বেশ কয়েকটি সাব- সেক্টরে বিভক্ত ছিল। সেক্টরগুলোর পরিচয় নিচে তুলে ধরা হলো-

মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টরের মানচিত্র

এক নম্বর সেক্টর : চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনীনদী পর্যন্ত এলাকা।

দুই নম্বর সেক্টর : নোয়াখালী, আখাউড়া, ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত, কুমিল্লা জেলা, সিলেট জেলার হবিগঞ্জ (বর্তমানে জেলা), ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ ।

তিন নম্বর সেক্টর : আখাউড়া, ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্ব দিকে কুমিল্লা জেলা, সিলেট, ঢাকা জেলার অংশবিশেষ ও কিশোরগঞ্জ।

চার নম্বর সেক্টর : সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল, খোয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন ছাড়াও পূর্ব ও উত্তর দিকে ডাউকি সড়ক পর্যন্ত অঞ্চল।

পাঁচ নম্বর সেক্টর : সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল, সিলেট-ডাউকি সড়ক থেকে সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়ক পর্যন্ত এলাকা । বঙ্গোপসাগর

ছয় নম্বর সেক্টর : রংপুর জেলা, দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমা (বর্তমানে জেলা)।

সাত নম্বর সেক্টর : দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা ।

আট নম্বর সেক্টর : কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুরের অধিকাংশ এবং খুলনা জেলার দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত এলাকা ।

নয় নম্বর সেক্টর : দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনা জেলার দক্ষিণাঞ্চল, ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ এবং বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা ।

দশ নম্বর সেক্টর : দশ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ-কমান্ডো, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথ ৷

এগার নম্বর সেক্টর : কিশোরগঞ্জ ছাড়া ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা।

ব্রিগেড ফোর্স

১১টি সেক্টর ও তার অধীন অনেক সাব-সেক্টর ছাড়াও রণাঙ্গনকে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয়। ফোর্সের নামকরণ করা হয় ব্রিগেডগুলোর অধিনায়কদের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে। মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন 'জেড ফোর্স, মেজর কে.এম. শফিউল্লাহ ছিলেন 'এস ফোর্স এবং মেজর খালেদ মোশাররফ কে ফোর্স- এর অধিনায়ক।

নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী

মুক্তিবাহিনী সরকারি পর্যায়ে দুইটি শাখায় বিভক্ত ছিল - ১. নিয়মিত বাহিনী ও ২. অনিয়মিত বাহিনী।

১. নিয়মিত বাহিনী : ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলোর বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়। সরকারিভাবে এদের নামকরণ করা হয় এম. এফ. (মুক্তিফৌজ)। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার নিয়মিত বাহিনী হিসাবে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীও গড়ে তোলে।

২. অনিয়মিত বাহিনী : ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ও সকল পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে অনিয়মিত বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর সরকারি নামকরণ ছিল 'গণবাহিনী বা এক. এফ. (ফ্রিডম ফাইটার বা মুক্তিযোদ্ধা)। তাদের নিজ নিজ এলাকায় গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য প্রেরণ করা হতো। এছাড়া ছাত্রলীগের বাছাইকৃত কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় 'মুজিববাহিনী'। কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী) ও ছাত্র ইউনিয়নের আলাদা পেরিলা দল ছিল।

আঞ্চলিক বাহিনী : সেক্টর এলাকার বাইরে আঞ্চলিক পর্যায়ে যেসব বাহিনী গড়ে উঠে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কাদেরিয়া বাহিনী (টাঙ্গাইল), আসার ব্যাটালিয়ন (ভালুকা, ময়মনসিংহ), ৰাতেন বাহিনী (টাঙ্গাইল), হেমায়েত বাহিনী (গোপালগঞ্জ, বরিশাল), হালিম বাহিনী (মানিকগঞ্জ), আকবর বাহিনী (মাগুরা), লতিফ মীর্জা বাহিনী (সিরাজগঞ্জ, পাবনা) ও জিয়া বাহিনী (সুন্দরবন)। এছাড়া ছিল ঢাকার গেরিলা দল, যা 'ক্র্যাক প্লাটুন' নামে পরিচিত। ঢাকা শহরের বড় বড় স্থাপনা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ব্যাংক ও টেলিভিশন ভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ঢাকার গেরিলারা। এভাবে তারা পাকিস্তানি সেনা ও সরকারের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করে।

শুধু স্থলপথে নয় নৌপথে 'অপারেশন জ্যাকপট' নামে পরিচালিত অভিযান চলাকালে একদিনে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০টি এবং মংলা বন্দরে ৫০টি জাহাজ ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোগণ সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দেন।

নারীর অবদান

যেকোনো যুদ্ধে নারীর ওপর আঘাত আসে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। সম্মুখ যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ, সহযোগী যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা পালন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সেবাদানকারী হিসেবে তাঁরা অসামান্য অবদান রাখেন। মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে নারী হাসিমুখে সন্তান-ভাই-স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। নিজেরা হত্যা ধ্বংসযজ্ঞ এবং পাশবিকতার শিকার হয়েছেন। আবার অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহ করে, তথ্য দিয়ে, সংগঠক হিসেবে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অণুপ্রেরণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। সর্বোপরি যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে পরিবার আগলে রেখে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রেখেছিলেন নারীরা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি এবং ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।

কাজ-১ : বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কন করে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো চিহ্নিত করো ।

কাজ-২ : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)-এর গঠন ও কাজের বর্ণনা দাও ।

Content added By
Promotion